'মূল্যবোধ'
                     মিঠুন মজুমদার

         গোটা হাতিবাগান জুড়ে চোখ জুড়ানো ইমিটেশনের গয়না আর পথ চলতি মানুষের ভীড়। ঘড়িতে তখন অফিস টাইম পেরিয়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই। 

     হাতিবাগান থেকে বাসটা সবে হেদুয়ামুখী। ঠাসা ভীড় না হলেও ফাঁকা ছিল না বাসটি। ভেতরে বাস কন্ডাক্টরের হাক ডাক, বাসের হর্ন, পিছন থেকে ট্রামের ঘন্টা ধ্বনি, ভিতরে নানান কর্ম ব্যস্ত মানুষ, মোবাইলের ঝুকে পরা কিছু যুবক যুবতী এসবই চেনা ছবি।  অভিভাবকসহ কিছু স্কুল ফেরত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, পারফিউম লাগানো যুবকও ছিল সে বাসে। তবে বড্ড বেমানান এক সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধও ছিল তাতে। রুগ্ন, শুকনো, বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ। 

      সিনিয়র সিটিজেনের সিটটাতে যে সে বসবে তার উপায় ছিল না। কেননা সেখানেও এক আপাতত অল্প বয়স্ক এক বৃদ্ধ। কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়ে ঝুকে পরা শরীর নিয়ে দাড়িয়ে রইল। কাধে ঝুলানো ব্যাগটা বোধহয় একটু বেশিই ভারি ছিল। ঝুকে পরছিল বারবার। আর পুরু চশমার আড়ালে চোখ দুটি যেন কিছু একটা খুঁজছিল। হয়ত একটা বসবার জায়গা। বড্ড অসহায় লাগছিল।

      ফিটফাট পোষাক পরা লোকটির বোধহয় বড় অস্বস্তি লাগছিল এমন এক পড়ন্ত বেলার বৃদ্ধ তার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।শেষে একসময় বলেই ফেললো 
 "এভাবে দাড়িয়ে না থেকে পিছনে যান না, সিট পেয়ে যাবেন।" বৃদ্ধ পিছনের দিকে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে তথাকথিত ভদ্রলোকের উক্তি "আরে এদিকে কি সিট পাবেন? যান না সামনের দিকে।" বৃদ্ধ আবার সামনে। সাপ লুডু খেলা বেশ জমে উঠছিল।

      বাধ্য হয়ে সিনিয়র সিটিজেনের পাশের সিটে বসা এক সুশ্রী যুবককে চোখের ইশারায় অনুনয় করতেই, যুবকটি কান থেকে ইয়ার ফোনটি খুলে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কানে লাগিয়ে নিল। কিছুই যেন ঘটেনি। হয়ত ভ্রুক্ষেপহীন কলেজ পড়া যুবকটি এ শিক্ষা পায়নি।

      বাসটি ততক্ষণে হেদুয়া ছাড়িয়ে। পরের স্টপেজ থেকে উঠল জিন্স টপ পরা তন্বী। সোজা বৃদ্ধের পাশে। বারবার চুল ঠিক করতে ব্যস্ত ছিল মেয়েটি। নানান অছিলায় সবাই আর চোখে দেখছিল মেয়েটিকে। টানাটানা চোখ দুটির দিকে  সুশ্রী যুবকটির চোখ পরতেই এক গাল হাসি "আপনার কি দাড়াতে অসুবিধা হচ্ছে? আসুন, বসুন না।" গলায় বিনয় যেন ঝরে পরল।

"আর আপনি বসবেন না?" হেসেই প্রশ্ন করল মেয়েটি। 
"না না, আমি উঠছি। আপনি বসুন।" যুবকটির উত্তর।  
তন্বীর সুলজ্জ হাসিতে যেন সহস্র ফুল খসে পরল। কি মিষ্টি সে হাসি।

    যুবকটি তন্বীকে বসবার জায়গা করে দিতে উঠে দাড়াতেই সকলেই বাহবা দিল। দুঃছাই করে ওঠা প্যাসেঞ্জার আর লুডো খেলার অংশগ্রহণকারীরা তো বাঃ বাঃ করে উঠল। বলে উঠল "এই না হলে সংস্কার! নারীদের প্রতি সন্মানই তো আসল ধর্ম। "

      কিন্তু কি আশ্চর্য! তন্বীটি নিজে না বসে সেই বৃদ্ধকেই বসবার জন্য অনুরোধ করে বললেন "আমি দুঃখিত, আপনাকে এত সময় দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে।" বৃদ্ধটির ভারি ঝোলাটি নিজের কাধে নিয়ে তন্বীটি দাড়িয়ে রইল বৃদ্ধের পাশে। বৃদ্ধ কি ভাবল কে জানে, তন্বীর মাথায় রুগ্ন শীর্ন হাত রেখে শুধু এটুকুই বলল "ভালো থেকো মা।" 

      এত রৌদ্রোজ্জ্বল বেলায় হঠাৎ যেন বাসের মধ্যে কালো মেঘ নেমে এল।

মিঠুন মজুমদার