শ্রীমতির গল্প 
         (সেই মেয়েটা ) 
              ✒রাণা চ্যাটার্জী ✒

অফিস এর কাজ গুলো যেনো চারটের পর থেকে বেশি বেশি ভিড় জমায় টেবিলে ! যত্ত আর্জেন্ট রিপোর্ট  বানানো,মেল করা কি শেষ ঘন্টায়  আসতে হয় ! তার ওপর আচ্ছে দিনের শুভ সংকেত নিয়ে লুপ লাইনের ট্রেন লেট তো নিত্য সঙ্গী আমাদের,গা সওয়া একটা ব্যাপার ! যথারীতি গণ দেবতা এক্সপ্রেস গড়াতে গড়াতে ঘড়ির কাঁটা 8:17 হয়ে গেলো আজ বর্ধমানে পৌঁছাতে । চরম বিরক্তি মনে খেয়ালই করিনি ,বাড়ি থেকে অর্ধাঙ্গিনী তিন তিনবার ফোন করেছিল! নেমে হন্তদন্ত হয়ে ফোন করতেই আড়ষ্ট গলায় খবর পেলাম ভালো রকম জ্বর বেঁধেছে !
বাড়ি পৌঁছতে অষ্টম বর্ষীয়া কন্যার শুকনো মুখে বার্তা "মা জ্বরের ঘোরে ,ভীষন গা গরম স্কুল থেকে ফিরতেই "।ওর অসহায়তা ,থার্মোমিটার নিয়ে জ্বর মাপা আমায় স্পর্শ করলো ,ইশ কত্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছে পুঁচকে মেয়ে আমার ! হাত পা একটু ধুয়ে পাশে বসতেই চমকে উঠলাম ,বাপরে এত্ত জ্বর ,বিছানাটা তো পুড়ে যাচ্ছে যেনো ! দেখলাম কি যেনো বিড় বিড় করছে আর মেয়েকে জড়িয়ে ধরছে ।
ক্যালপল 650 দেবার আগে দু টুকরো রুটি,  সবজি মা কে খাইয়ে দেবার ,মেয়ের  প্রয়াস করার ফাঁকে ,একটু স্যুপ বানাতে রান্না ঘর গিয়ে  আওয়াজে বুঝলাম জ্বরের ঘোর কাটিয়ে  উঠে বসেছে শ্রীমতি ।

ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে ডক্টর এর খোঁজ নিয়ে এসে  চা নিয়ে পাশে বসতেই ওষুধের প্রভাবে উঠে বসে যে কথাটা গল্প আকারে ওর মুখ থেকে  সংক্ষেপে শুনলাম বুঝতে বাকি রইল না ,ঠান্ডা লাগা ছাড়াও এক মানসিক অস্থিরতা ওকে যথেষ্ট নাড়া দিয়ে গেছে আজ মনে !

প্রতিদিনের মতো আজো বাড়ির সামনের বাস স্টপ থেকে নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়ে শ্রীমতি । এই শীতের সকাল,সংসারের  সাত ঝামেলা সেরে সময়ে রোজ স্কুলের বাস ধরতে ,নিজের দিকে ভালো করে তাকানোর ফুরসত টুকুও আজকাল কেড়ে নিচ্ছে যেন ।

বাসে উঠতেই সামনের একটা খালি সিট দেখে বসতেই আজ নজর কেড়ে নিলো পাশে বসা এক ঝাঁকড়া কালো চুলের এক মেয়ে ।কতোই আর বয়স হবে ,ওই বড়জোর আমাদের মেয়ের থেকে একটু বেশি ,নয় কি দশ ।গোল মায়াবী মুখ খানা ,কিন্তু মুহূর্তেই বুঝতে অসুবিধা হয় না ,যেনো ভেতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ! ওরে বাবা চোখ গুলো যে জলে টস টস আর লাল করে ফেলেছে ! স্বাভাবিক ভাবে শ্রীমতি প্রশ্ন করে ওঠে ,"কি রে ,কাঁদছিস কেনো ,কে আছে সঙ্গে "? পেছন থেকে এক যুবক খুব ধীরে জানালো ,"দুদিন আগে মেয়েটার মা মারা গেছে "! কথাটা ছেলেটার মুখ থেকে শোনা মাত্র বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে এক লহমায় শ্রীমতীর ,"আহারে,এই টুকু বয়সে মা কে হারিয়ে ! মা ছাড়া এই বয়স থেকে কেই বা ওর খেয়াল রাখবে ! এই সব ভাবনার মাঝে বাচ্ছাটিকে ওর বাবার কথা ,বাড়িতে কে আছে আর জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আবার মোক্ষম ধাক্কা খায় । বাচ্ছাটি জানায় ,বাবা আগেই ওদের ছেড়ে চলে গেছে ,মা খুব অসুস্থ ছিলো ,আর বাড়িতে ওর একটা দাদা আছে ! হে ভগবান ,মা বাবা ছাড়া এমন অভিভাবকহীন ওর পুঁচকে জীবন যে  অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে !

ততক্ষণে বাস এগিয়ে চলেছে শহরের ভিড় ঠেলে ,গ্রাম্য পথের রেখা দেখতে পাওয়া, সবুজ জমির বুক চিরে কালো পিচ রাস্তা ধরে ।মনের মধ্যে নিজের মেয়েটা একা কি করছে স্কুলে এতক্ষণ ,টিফিন খেলো কিনা এই সব প্রশ্নের ভিড়ে মেয়েটার মাথায় এলো চুলে একটু স্নেহের পরশ দিতে ইচ্ছে করে খুব ।সম্বিত ফিরতেই নিজেকে একটু ঠিক করে নিয়ে শ্রীমতি ওকে প্রশ্ন করে ,"কি রে কাজ কর্ম কিছু করতে পারিস ,একটু নিজের খেয়াল রাখিস কেমন "। মুখ তুলে লাল টকটকে চোখে শুকিয়ে যাওয়া  জলের সাক্ষী রেখে একটু যেনো সাবলীল হয়ে উঠলো বাচ্ছাটা ,অস্ফুট স্বরে জানালো ,কোনদিন তো তেমন ভাবে বাড়ির কাজ করার প্রয়োজন হয়নি ,বলে আবার যেনো ফুঁপিয়ে উঠলো । ওকে সামান্য স্বান্তনা দিতেই ,যা ভীষণই আজ নগণ্য মেয়েটার কাছে , কন্ডাক্টর হাঁক ছাড়লেন ,'ও ম্যাডাম আসুন আসুন ,আপনার স্টপেজ এসে গেছে !'
বাস থেকে নেমে কেমন যেনো একটা বিশ্রী অনুভূতি ,শরীর টা ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে হটাত ,কেমন যেনো হাত ,পা গুলোতে ভার ভার ,আড়ষ্ট ভাব । আজ স্কুলে স্বরস্বতী পুজোর খিচুড়ি ভোগ খাওয়ার দিন ,এক বিন্দু মুখে তুলতে পারলো না শ্রীমতি । বারবার সেই ঝাঁকড়া চুলের মায়াবি মুখ খানা ভেসে আসছে মনে ,চোখের কোল ভিজিয়ে দিয়ে ফ্লাশব্যাকে নিজের মেয়ে তাথৈ কে  ভীষণ ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে !
সেও কেমন একাকী সেই দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে  স্নান ,খাওয়া ,নিজের কাজ টুকু করে সারাদুপুর না ঘুমিয়ে খেলে বেড়ায় ।একদম বাড়ি লাগোয়া  ব্যস্ত যানযট দ্রুতগতির রাস্তায় যদি বেরিয়ে পরে দরজায় কারুর কড়া নাড়া শুনে ! যদি হটাত্  আমারও কিছু হয়ে যায় ! এই সব ভাবনার ভিড় বাড়তে বাড়তে  স্কুলে দুপুর থেকেই গা গরম হয়ে শরীর খারাপ হয়ে যায় আর বাড়ি ফেরার পর ধুম জ্বর আসে । এমন ধুম জ্বর শেষ কবে এসেছে মনে পরেনা শ্রীমতির ! জ্বরের ঘোরে মাকড়সার জালের মতো কেমন যেনো ভাবনার জাল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে ,যেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে তাঁকে ,দমবন্ধ হয়ে  ছটফট করে ওঠে ঘুমের মধ্যেই ।

রাতে ডক্টর দেখিয়ে এসে আমি সারা রাত  উপলব্দি করি বাচ্ছা মেয়েটির মানসিক টানাপোড়েন !ওই ঝাঁকড়া চুলের ফুলের মতো মেয়েটিকে অনুভবে আমিও দেখতে পাই ,উঠে বসি ,জল খাই । আবার পাশে শুয়ে উপলব্ধি করি সেই বাসের ঘটনাটা ,যা কিনা শ্রীমতিকে সারারাত ছটফট আর এপাশ ওপাশ করে ছেড়েছে এক অদ্ভুত বোবা কান্নায় !

😯😅😪😓😔😑😢😧😭😩😪😯
        
                    "হৃদ মাঝারে "
                 ✒  রাণা চ্যাটার্জী ✒

"এই সৌমি ,সৌমি ,কি আশ্চর্য্য তো ,সেই যে ঘরে ঢুকলো আর বেরুবার নামগন্ধ নেই !" এক নাগাড়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক পেড়ে যাচ্ছেন বছর চল্লিশের অন্নপূর্ণা । ওই আবার শুরু করলেন ,"জানিনে বাবা,আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি ,এই হাসি খুশি তো এই মুখ গোমড়া ! শরতের মেঘ এমন হয় দেখে এসেছি ,মা বাপের সাথে যে দুটো হেসে কথা বলবে ,মোবাইল কানে গুঁজে সে ফুরসৎ টুকু নাই গো "

গত সপ্তাহ থেকে প্রতিটা মুহূর্ত ,এক আনন্দ উত্কণ্ঠায় কাটছিলো সৌমির ।পাড়ার নামি দর্জি জয়ন্তদার কাছ থেকে রীতিমতো ঝগড়া করে ,তবে সালোয়ারটা কাটাতে পেরেছে জলদি ।আরে অভি যে বাড়ি আসছে পুনে থেকে ,ওর সামনে কি পুরোনো ড্রেস পড়ে যাওয়া যায় ,না সমীচীন ! মা, বাবা যাই বলুক না কেনো ,অভীক দা মোটেই খারাপ ছেলে নয় ।বাইরের রূপটাই কি আসল হলো একটা মানুষের ।বাবা যেভাবে ,  মুখের ওপর বলেই দিলো সেদিন ,"অমন ক্যাবলা চাউনির সেই কালো ছেলেটাকে জামাই বলে কোনোদিন মানতে পারবোনা "।খুব বুকে বিঁধেছিলো কথাটা সেদিন সৌমির ।এই ভাবে বাইরের থেকে মানুষকে কখনো বিচার করতে নাই ,এটাই সে জানে ।আর অভীক তো সেই ছোটো থেকে এ বাড়িতে যাওয়া আসা করতো ।ভাবনা গুলো দলা পাকিয়ে ওঠে সৌমির ।বাবা,মা-ই না শিখিয়েছিল "মানুষ কে ঘৃণা করো না "!

তখন দমদমের এক এঁদো গলির এক কামড়া রূমে বেড়ে ওঠা সৌমির।চোখের সামনে বড্ড জীবন্ত সেই অভাবের দিন গুলো ।আজ কেমন যেনো পাল্টে গিয়ে বৈভবের থরো থরো আতিসজ্জায় । তাবলে মানুষের মন কি এভাবে পাল্টাতে আছে ? এই প্রশ্নেরই উত্তর তার চোখের সামনে বাড়িতেই আজ ।

সদ্য কলেজে কেমিস্ট্রিতে অনার্স নেওয়া মেধাবী ছাত্র অভীকদা একটা ভালো টিউশান খুঁজছিলো । এই খবরটা পাড়ার কোনো এক কাকুর কাছ থেকে পেয়েই বাবা আর দেরি করেন নি । এক রবিবার বিকালে হাজির করে আনে সৌমি দের এক কামড়া চালা ঘরে। ক্লাস নাইনে ওঠা সদ্য কিশোরী মেয়েটি সেদিন সোজাসুজি তাকাতেই পারেনি লজ্জায় ,কিন্তু মনে আছে চেক কাটা একটা খদ্দরের জামা আর তেলচিটে প্যান্টের শীর্ণকায় কেউ যেনো বইগুলো নাড়াচাড়া করছিলো ।

ঝম ঝমে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় শশব্যস্ত মা ,পড়িমরি করে ঝাপটায় ভিজে যাওয়া ঘুঁটে গুলো বারান্দায় চাপা দিচ্ছিলো । ভিজে গেলে আগুন ধরবে না এই ভয়ে । সৌমি উপলব্ধি করেছিলো ,সেই আর্দ্র পরিবেশেও  লজ্জায় তার কান গরম হয়ে গিয়েছিলো, এই প্রথম কোনো ছেলের সামনে এভাবে পড়তে বসে ।
তারপর ,দুদিন পর থেকেই সড়গড় হয়ে যায় ওরা । আজও মনে পড়ে সেই দিন গুলো খুব সৌমির।

ক্লাস এইটের অঙ্ক পরীক্ষায় কিছুটা কম নম্বর পেলেও ভালো গৃহ শিক্ষকের গুনে ভীষণ ভালো  রেজাল্ট করেছিলো সৌমি।প্রচুর প্রচুর হোম ওয়ার্ক নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা  মুখ গুঁজে পরে থাকা আর মেধাবী অভীক দার দুর্দান্ত পড়ানোর কৌশলে মাধ্যমিকে অষ্টআশি শতাংশ নম্বর পেয়েছিলো ।এর পর থেকে আরও পড়াশোনায় সিরিয়াস হয়ে যাওয়া সৌমিকে আর পিছনে তাকাতে হয় নি ।

অভীক দা তখন ,যাকে বলে এক নির্ভরতা হয়ে উঠেছিল সেদিন সৌমিদের । বাবার সাথে ব্যাঙ্কে ,এমনকি বাজারে ,লাইটের বিল যেকোন কাজের বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে চুপচাপ সবকিছু করে যেতো ।এই নিয়ে সৌমি,দু তিন বার প্রতিবাদ করেও মা ,বাবা কেউই কর্ণপাত করতো না ।তখন মা বরং খুশি হয়েই স্বপ্নের বীজ বুনতো সৌমি আর অভীক কে নিয়ে ।
তারপর হটাত্ করেই অভীকদার বাবা মারা যেতেই ওরা ভাড়া ছেড়ে উঠে যায় অন্য কোনো কলোনীতে ।পরে যোগাযোগ আর না হয়ে উঠলেও কোথায় যেনো একটা ভালোলাগা ,সৌমির মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে গেছিলো । 

এক আশ্চর্য্য দৈব বলের মতো হটাত্ করে ,সৌমিদের অবস্থার দারুণ উন্নতি ঘটে যায় । সৌমির এক দূর সম্পর্কের মামিমা, নিঃসন্তান ও কেউ না থাকায় তার যাবতীয় সম্পত্তি ,বাড়ি ,জমি সবকিছু সৌমির মায়ের নামে উইল করে যায় ।ব্যস ,আর ঘুরে তাকাবার প্রশ্নই ওঠে না । সেই রেশ ধরেই আজকের এই বৈভব ,মান মর্যাদা ।শহরের 
বুকে পেল্লাই দু-দুটো ফ্ল্যাট ,বাগান বাড়ি ।সৌমি ও ইঞ্জিয়ারিং পড়ে খুব ভালো জব করছে ।

মাস খানেক আগেই ফেসবুকে সার্চ করতে করতে "অভীক দত্ত "নাম দিতেই অনেক অভীক এর মাঝে সেই লাজুক ,মায়াবী চোখ দেখে এক মুহূর্তও চিনতে ভুল  হয়নি সৌমির ,ও প্রান্ত থেকে চট জলদি রিপ্লাইও এসে গেছিলো ।এই কদিনে যেটুকু কথা বার্তা হয়েছে ,অভীক একটা ছোটো খাটো জব নিয়ে পুনে তে চলে আসতে বাধ্য হয় । যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তার পথ চলা শুরু তা আর্থিক টানা পোড়েনে অস্তমিত প্রায় ।সব কিছু শুনেও সৌমির আবেগ,ভালোবাসায় সত্যই কোনো কিছু যায় আসে না ।সে তার মন প্রাণ ,আবেগ সব কিছু সেদিনের সেই অভি দা কেই যে দিয়ে বসে আছে তা বেশ অনুভব করে ।অভীক কুণ্ঠাবোধ করলেও আগামী সপ্তাহে পুনে থেকে বাড়ি আসছে শুনে ,সৌমি ভীষণ ভাবে দেখা করতে চাওয়ার অনুরোধ করে রেখেছে,যা ফেরানো সেদিনের কালো ,শীর্ণকায় মেধাবী ছাত্র,আজকের অভীকদার ও নাই ।এই বিষয়টা স্পষ্ট ভাবে মা ,বাবা কে বলার পর থেকেই ঘরের পরিবেশটা কেমন যেনো গুমোট হয়ে গেছে ।
অর্থ  পরিবেশ ,পরিস্থিতি ,মানুষ কে পালটে দিলেও সৌমি তার প্রিয় অভীকদার প্রতি আজও তীব্র এক টান অনুভব করে তার আসার অপেক্ষায় বাড়ির প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে ।